রাজধানীর সড়ক ব্যবস্থাপনা কোন পথে?

Passenger Voice    |    ১১:১৭ এএম, ২০২২-০৪-০৬


রাজধানীর সড়ক ব্যবস্থাপনা কোন পথে?

ঢাকার প্রধান সমস্যা যানজট। এই যানজট নিরসনে কার্যকরি কোনো পদক্ষেপ নেই। রাস্তায় বের হলে গন্তব্যে কখন পৌঁছা যাবে তা নির্দিষ্ট করে বলার সুযোগ নেই। নিরাপদে পৌঁছারও নিশ্চয়তা নেই।

মিরপুর ১০ নম্বর থেকে মতিঝিল আসতে সময় লাগে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা। অথচ যানজট না থাকলে এ পথের দূরত্ব সর্বোচ্চ ১৫ মিনিটের। রাজধানীবাসীর কেউ কেউ হয়তো ভাবছেন মেট্রোরেল হয়ে গেলে যানজট থাকবে না। যারা এমন ভাবছেন তাদের ভাবনায় ভুল আছে। কারণ ঢাকার মাত্র ১৫ ভাগ লোক মেট্রোতে চলাচল করতে পারবেন। বাকি ৮৫ ভাগ লোকের চলাচলের ব্যবস্থা বিদ্যমান অবস্থায়ই থাকবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন- শহরের জনসংখ্যা ৭০ লাখের বেশি হলে সেখানে বিনিয়োগের ফলাফল কম আসে। ঢাকার জনসংখ্যা বর্তমানে দেড় কোটি থেকে দুই কোটি বলা হয়ে থাকে। অথচ এ শহরে নতুন করে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ করা হচ্ছে। এই বিনিয়োগ শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কে জানে। ঢাকার বিশাল জনগোষ্ঠীর শহরে যানজটের ফলে যে শুধু সময় নষ্ট হয়, তা নয়। ক্ষতি হয় বিপুল পরিমাণ জ্বালানিরও। যানজট নিরসন না হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, সড়ক ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি ও গণপরিবহণে বিশৃঙ্খলা। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও ঢাকায় একটি কার্যকর গণপরিবহণ ব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। 

কেন যানজট?
ঢাকার যানজটের কারণগুলোর একটি হলো যত্রতত্র গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানো।  এক্ষেত্রে চালকদের যেমন সচেতনতার অভাব আছে, তেমনি অসচেতন যাত্রীরাও। অপ্রতুল পার্কিং স্পেসও একটি সমস্যা। ঢাকার বিভিন্ন সড়কের ফুটপাথ ও রাস্তা দখল করে গাড়ি রাখা হচ্ছে। এ শহরের বেশিরভাগ ভবনেরই নেই নিজস্ব পার্কিং ব্যবস্থা। ফলে এ সব ভবনে আসা গাড়িগুলো পার্ক করা হয় ফুটপাথে কিংবা সড়কের ওপর, যেটা যানজটের অন্যতম একটি কারণ। যে কোনো বড় রাস্তারই দুটো দিক থাকে।

গাড়ি আসার একদিক আর যাওয়ার একদিক। ঢাকা শহরে যানজটের একটা প্রধান কারণ উল্টো পথে গাড়ি চালানো। রাস্তায় ট্র্যাফিক জ্যাম হলে অনেককেই দেখা যায় গাড়ি ঘুরিয়ে ঝট করে উল্টো দিকের চলে যেতে। এতে করে যানজট তো বাড়েই, দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও থেকে যায়। ঢাকার যানজটের অন্যতম একটি কারণ দীর্ঘ সময় ধরে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি। ঢাকা শহরের যানজটের কারণের মধ্যে আছে দীর্ঘ সময় ধরে উড়াল সেতু নির্মাণও। উড়াল সেতু নির্মাণ সামগ্রী ফেলে রাখা হচ্ছে সড়কের বেশিরভাগ জায়গায়।

ফলে তৈরি হচ্ছে যানজট।  তাছাড়া এ সব উড়াল সেতু নির্মাণে সঠিক পরিকল্পনারও অভাব আছে। ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রেই আছে কমপক্ষে ২০টি রেল ক্রসিং। এসব ক্রসিং থেকে দিনে কমপক্ষে ৭০টিরও বেশি রেলগাড়ি চলাচল করে। এক হিসাব মতে, এই ক্রসিংগুলোর কারণে দিনে প্রায় ছয় ঘণ্টা যানবাহন আটকে থাকে ঢাকায়।

ঢাকা শহরের বেশিরভাগ ডাস্টবিনই সড়কের ওপরে। এসব ডাস্টবিনে উপচেপড়া ময়লা আবর্জনা সড়কের উপরও ছড়িয়ে পড়ে। ফলে সেসব জায়গায় কম গতিতে চলে যানবাহন। তাছাড়া রাতের বেলা ময়লা আবর্জনা পরিষ্কারের নিয়ম থাকলেও তা মানা হয় না। যত্রতত্র এসব ডাস্টবিনের কারণেও যানজটের সৃষ্টি হয় মহানগরীতে। 

কীভাবে আগে যাবেন? হেঁটে নাকি যানবাহনে 

জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে ২০১৮ সালের ২০ মে ঢাকার যানজট নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়- রাজধানী ঢাকায় যানজটের কারণে প্রতিদিন ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। আর এ যানজটে বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৭ হাজার কোটি টাকা, যা জাতীয় বাজেটের ১১ ভাগের এক ভাগ। বুয়েটের গবেষণায় উঠে আসা তথ্যের ভিত্তিতে ডয়চে ভেলে ওই পরিসংখ্যান তুলে ধরে।

২০১৮ সালের ১৯ মে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট (এআরআই) এবং রোড সেফটি ফাউন্ডেশন আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে এই তথ্য জানানো হয়। ওই গোল টেবিল বৈঠকে বলা হয়- ‘নগরের যানজট যদি ৬০ শতাংশ কমানো যায় তবে ২২ হাজার কোটি টাকা বাঁচানো যাবে।’ বুয়েটের ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়- ‘ঢাকায় যানজটের কারণে পিক আওয়ারে গণপরিবহনগুলোর গতিবেগ ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটারে নেমে এসেছে, যেখানে পায়ে হেঁটে চলার গড় গতিও ৫ কিলোমিটার।’ তার মানে হলো পিক আওয়ারে গাড়ির গতি এবং হাঁটার গতি একই। ২০১৮ সালের ১২ বছর আগেও এই গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। 

২০১৮ সাল মে মাস থেকে ২০২২ সালের এপ্রিল প্রায় চার বছর। আর এই চার বছরের ব্যবধানে মানুষের হাটার গতির চাইতে যানবাহনের গতি কম। ঢাকা শহরের পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা দেখে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (আরএসটিপি) আশঙ্কা করা হয়েছিল ২০৩০ সালের দিকে সড়কে যানের গতি মানুষের হাঁটার গতির চেয়েও কমে আসতে পারে।

২০২০ সালে করা বুয়েটের এক গবেষণায় দেখা যায়, সড়কে পিক টাইমে চলাচল করা যানবাহনের গড় গতি ছিল ঘণ্টায় সাড়ে ছয় কিলোমিটার। চলতি বছরে এই গতি নেমে এসেছে প্রায় ৪.৮ কিলোমিটারে। উল্টোদিকে বর্তমানে শারীরিকভাবে সুস্থ মানুষের হাঁটার গড় গতি প্রতি ঘণ্টায় এর চেয়েও বেশি। বিশ্ববিখ্যাত গবেষণা প্রকাশনী সংস্থা ‘প্লাস ওয়ান জার্নাল’ এক গবেষণায় বলছে, ২০-২৯ বছর বয়সী মানুষের হাঁটার গতি ঘণ্টায় ৪.৯ কিলোমিটার। ৩০ থেকে ৫০ ঊর্ধ্ব বছর বয়সী মানুষের হাঁটার গতি ঘণ্টায় ৫.১ কিলোমিটার।

ষাটোর্ধ্বদের ক্ষেত্রে এই গতি ঘণ্টায় ৪.৮২ কিলোমিটার আর সত্তরোর্ধ্ব মানুষ ঘণ্টায় হাঁটতে পারেন ৪.৫ কিলোমিটার। এসব বয়সী মানুষের গড় হাঁটার গতি দাঁড়ায় ঘণ্টায় ৪.৮৩ কিলোমিটার, যেটি বর্তমানে পিক টাইমে ঢাকার সড়কে চলা গাড়ির গতির চেয়েও বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘কিছু প্রধান সড়কে গাড়ি চলার গড় গতি ঘণ্টায় ৪.৮ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। দুই বছর আগেও এই গতি সাড়ে ছয় কিলোমিটার ছিল।

এটা খুবই উদ্বেগজনক। আরএসটিপিতে যে আশঙ্কা ছিল, তা এখনই দৃশ্যমান। পরিকল্পিতভাবে সড়কে উন্নয়ন ও যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পরিস্থিতি আরো ভয়ংকর হবে। তাছাড়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকার ফলে যাত্রীদের মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে। এই চাপ আবার কাজ করছে অন্যান্য রোগের উৎস হিসেবে। যানজট ৯ ধরনের মানবিক আচরণকে প্রভাবিত করছে বলেও জানা গেছে। 

লেখক: হাসান আল বান্না, সংবাদকর্মী।